তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যদিয়ে শেষ হলো গ্রীষ্মকাল; শুরু হলো স্বস্তির বর্ষা। বর্ষার প্রথম দিনে সকালে আকাশ মন খারাপ করে বসে থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন রাগ কমেছে।
মানুষের মতো প্রকৃতিও কি কাঁদে বলেই বর্ষা আসে? না অন্য কোনো কারণ আছে?
বৃষ্টি মূলত তপ্ত ধরণীকে শীতল করতে আসে। বৃষ্টি সব কিছুকে ভিজিয়ে স্বস্তি দেয়। এতে গ্রীষ্মের তাপপ্রবাহের পর সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। আর এ কারণেই বৃষ্টি নিয়ে অগণিত গান ও কবিতা লিখেছেন কবি-সাহিত্যিকরা। বর্ষা নিয়ে মানুষের আবেগের যেন শেষ নেই। তাইতো বিশ্বকবি বর্ষার প্রতি ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে লিখেছেন, ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে, জানিনে জানিনে কিছুতে কেন যে মন লাগে না।’
ষড়ঋতুর দেশের দ্বিতীয় ঋতু বর্ষা। বাংলা মাস আষাঢ় ও শ্রাবণ নিয়েই হয় বর্ষাকাল। এ ঋতু নিয়ে যেন সবার একটু বেশিই মাতামাতি। এ সময়েই ফোটে কদম, বকুল, স্পাইডার লিলি, দোলনচাঁপা, সুখদর্শন, ঘাসফুল, শাপলা, সন্ধ্যামালতি, কামিনী, গুলনার্গিস, দোপাটি ও অলকানন্দ ইত্যাদি। বর্ষা মানেই কদম ফুল। তাই বর্ষার শুরুতেই মেলে কদমের সৌরভ।
বর্ষা প্রেমের ঋতু। তাইতো কবি আবুল হাসান লিখেছিলেন, ‘বৃষ্টি চিহ্নিত ভালোবাসায়, বৃষ্টি হলেই না সে রকম সারা দিন হৃদয়ের অক্ষরভরা উপন্যাস পড়া যায়।’ তবে বর্ষা যতটা স্বস্তির, ততটা আবার বিষাদেরও। তবুও সবাই বর্ষাকেই আপন করে নেয়। আর শহরাঞ্চলে তো বর্ষা নিজের রূপ হারিয়েছে। নেই চিরচেনা সেই কদম ফুলের সুবাস। আর কেমন জানি কদম ছাড়া বর্ষা পরিপূর্ণ নয়! তারপরও জরাজীর্ণ গ্রীষ্মক্লান্ত প্রকৃতিকে বর্ষার আকাশ-ভাঙা জলে স্নান করিয়ে সিক্ত হয় ধরণীতল। ইট-কাঠের ফাঁকেই যেন স্বস্তি খোঁজেন সবাই।
প্রেমের সঙ্গে সঙ্গে বর্ষা অনেক রোমান্টিকও। তবে এর রোমান্টিকতায় বিপদে পড়তে হয় অনেককে। যেমন: দিনমজুর আর খেটে খাওয়ারা; দিন আনে দিন খায় যারা, তাদের হয়ে যায় না খেয়ে থাকার দশা!
তবে বর্ষায় পুরাতন জঞ্জাল ধুয়ে-মুছে আমরা যেন জেগে উঠি প্রাণচাঞ্চল্যে। এ সময় মেঘের গুড়ুম গুড়ুম গর্জনে ময়ূর পেখম তুলে নাচে। এর চেয়ে মনোমুগ্ধকর আর কীই-বা হতে পারে! ঋতুচক্রে আষাঢ়-শ্রাবণ দু মাস মিলিয়ে বর্ষাকাল। আজ পয়লা আষাঢ়, অর্থাৎ বর্ষার প্রথম দিন। আষাঢ় শব্দটি এসেছে পূর্বাষাঢ়া ও উত্তরাষাঢ়া নক্ষত্রে সূর্যের অবস্থান থেকে। আষাঢ় বাংলা সনের তৃতীয় মাস। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে জুন-জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে আষাঢ় আসে।
বর্ষা মানবমনে সঞ্চার করে অনন্ত বিরহ-বেদনা-সুখ। মনকে উদ্ভাসিত করে অপার সৌন্দর্যলোকে। বর্ষার এক চোখে অশ্রু, অন্য চোখে হাসি। বর্ষা আমাদের মনকে প্রয়োজনের জগৎ থেকে নিয়ে যায় অনন্ত অভিসারে অন্য কোথাও। বর্ষায় কবি মন যাত্রা করে চির সৌন্দর্যের অমরাবতীতে। পরিচিত জগৎ-সংসারের বন্ধন তখন তুচ্ছ হয়ে যায়। মনে পড়ে প্রিয় বেদনার কথা। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সে জন্যই হয়তো বলেছেন- ‘এমন দিনে তারে বলা যায়,/এমন ঘনঘোর বরষায়।’ কিংবা, ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান/আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান।’
বর্ষায় যতদূর দৃষ্টি যায়, আকাশে বিস্তার করে থাকে পাংশুটে মেঘের জাল, প্রকৃতি নিথর নিস্তব্ধ। ঘরে বসে স্মৃতি রোমন্থন করা ছাড়া যেন আর কিছুই করার থাকে না। কবি শামসুর রাহমান বলেছেন,
‘শ্রাবণের মেঘ আকাশে আকাশে জটলা পাকায়
মেঘ ময়তায় ঘনঘন আজ একি বিদু্যৎ জ্বলে
মিত্র কোথাও আশপাশে নেই, শান্তি উধাও
নির্দয় স্মৃতি মিতালি পাতায় শত করোটির সাথে।’
রোমান্টিক কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বৃষ্টির ভেতর রমনীয় আল্পনা এঁকেছেন। বৃষ্টিতে মানবীয় মুখ কেমন দেখায়, কেমন রোমাঞ্চকর হয়ে ওঠে, তা বর্ণনা করেছেন নিঁখুতভাবে। বৃষ্টি হয়ে ওঠে চাঞ্চল্যকর রোমান্টিক উপমা। কবি বৃষ্টি বিধৃত গোধূলী ও সন্ধ্যার বর্ণনা দিয়েছেন চমৎকারভাবে।
‘বাইরে বৃষ্টি, বিষম বৃষ্টি, আজ তুমি ওই রুপালি শরীরে
বৃষ্টি দেখবে প্রান্তরময়, আকাশ মুচড়ে বৃষ্টির ধারা।’
আমি দূরে এক বৃষ্টির নিচে দাঁড়িয়ে রয়েছি, একলা রয়েছি
ভিজেছে আমার সর্ব শরীর, লোহার শরীর, ভিজুক আজকে
বাজ বিদ্যুৎ একলা দাঁড়িয়ে কিছুই মানি না।’
এক পশলা বৃষ্টি যে নতুন মাত্রা নিয়ে আসে জীবনে, তা অন্য কিছুতেই পাওয়া যায় না। বর্ষায় বাংলার নদনদী পূর্ণযৌবনা হয়ে ওঠে। নদীর ফেঁপে ওঠা জোয়ারের পানি প্রচুর পলি জমায় মাটিতে, যা নিয়ে আসে শস্যেও প্রাচুর্যের কবর। এ সময় বিলে-ঝিলে ফোটে শাপলা-শালুক। হিজল আর কেয়াফুলের অরূপ দৃশ্য মোহিত করে মনকে। বর্ষাকাল গ্রামের মানুষকে অনেক বেশি ঘরমুখো করে তোলে। রমণীরা ঘরে বসে নকশি কাঁথায় ফুল তোলে। অনেকটা আলস্যে কেটে যায় দিন।
‘পল্লী-বর্ষা’ কবিতায় জসীম উদদীন বর্ষার অবিশ্রান্ত বর্ষণমুখর গ্রাম-বাংলার ঘরে ঘরে যে আড্ডার আসর বসে, ফাঁকে ফাঁকে পল্লী বাংলার শ্রমজীবী মানুষের অসমাপ্ত কাজগুলোও যে আড্ডার ছলে সারা হয়ে যায় সেই কিচ্ছা-কাহিনি শোনার যে লোকায়ত চিত্র তা তুলে ধরা হয়েছে কবিতায়-
‘গাঁয়ের চাষিরা মিলিয়াছে আসি মোড়লের দলিজায়
গল্প গানে কি জাগাইতে চাহে আজিকার দিনটায়!
কেউ বসে বসে কাখারী চাঁচিছে, কেউ পাকাইছে রশি;
কেফবা নতুন দোয়াড়ীর গায়ে চাকা বাঁধে কষি কষি।’
জ্যৈষ্ঠের খরতাপে যখন চৌচির প্রকৃতি, ঠিক সেই সময় স্বস্তির বার্তা নিয়ে আসে আষাঢ়। কিন্তু নগরজীবনে আষাঢ়ের বৃষ্টি আশীর্বাদের বদলে বয়ে আনে দুর্ভোগ। বিশেষত রাজধানী ঢাকায় সামান্য বৃষ্টিতেই সড়কে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। আর ভারী বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। কয়েক ঘণ্টার ভারী বৃষ্টি হলে সড়কে জমে হাঁটু পানি, কোথাও কোথাও কোমর পানি। নর্দমার নোংরা পানির সঙ্গে বৃষ্টির পানি একাকার হয়ে যায়। চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়ে।
বর্ষা হঠাৎ যেমন যেমন আনন্দের, তেমনি বেদনার। বর্ষার নির্মম অব্যাহত অঝোর ধারা কখনো জনজীবনে ছন্দপতন নিয়ে আসে। বিশেষ করে কর্মজীবী মানুষদের পীড়ার কারণও হয়ে দাঁড়ায়। তাদের দিন এনে দিনাতিপাতে যথেষ্ট বিড়ম্বনা এনে দেয় বর্ষা।