কোলকাতার ঘিঞ্জি এলাকায়, আওয়ামী লীগের গোপন পার্টি অফিস : বিবিসি প্রতিবেদন

ভারতের কলকাতায় একটি বাণিজ্যিক কমপ্লেক্সে আওয়ামী লীগ ‘পার্টি অফিস’ খুলে কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে বিবিসি বাংলার এক সরেজমিন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি গতকাল প্রকাশ করা হয়।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কলকাতা লাগোয়া উপনগরীটিতে শয়ে শয়ে বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স, রাতদিন লাখো মানুষের ভিড় সেখানে। ব্যস্ত এই এলাকায় একটি বাণিজ্যিক কমপ্লেক্সে এমন কয়েকজন যাতায়াত করছেন, যাদের কয়েক মাস আগেও সেখানে দেখা যেত না।

ওই বাণিজ্যিক পরিসরে যাতায়াত করেন, এমন বেশির ভাগই চেনেন না এই নবাগত ব্যক্তিদের। তবে তাদের অনেকেই মাত্র এক বছর আগেও বাংলাদেশের সব থেকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তারা আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর শীর্ষ ও মধ্যম স্তরের নেতা। তারা যে বাণিজ্যিক কমপ্লেক্সটিতে যাতায়াত করছেন কয়েক মাস ধরে, সেখানেই ‘দলীয় দপ্তর’ খুলেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

এই পার্টি অফিসটি নতুন। এর আগে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ছাড়ার পরের কয়েক মাসে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে যারা ভারতে অবস্থান করছেন, তারা নিজেদের মধ্যে ছোটখাটো বৈঠক বা দলীয় দপ্তরের কাজকর্ম চালাতেন নিজেদের বাসাবাড়িতেই। বড় বৈঠকগুলো অবশ্য করতে হতো কোনো রেস্তোরাঁ বা ব্যাংকুয়েট হল ভাড়া করে। সে কারণেই একটা নির্দিষ্ট পার্টি অফিসের দরকার ছিল বলে জানাচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।

কী রকম সেই পার্টি অফিস : বাণিজ্যিক পরিসরটির পেছনের দিকের ভবনটির আট তলায় লিফট দিয়ে উঠে বাঁ-দিকে গেলেই সার দিয়ে বাণিজ্যিক সংস্থার দপ্তর। করিডরের দুই দিকে হালকা বাদামি রঙের একের পর এক দরজা। তার মধ্যেই একটিতে আওয়ামী লীগের পার্টি অফিস। শুধু বাইরে কেন, ৫০০ বা ৬০০ স্কয়ার ফুটের ঘরটিতে উঁকি মারলেও কেউ বুঝতে পারবেন না যে এই ঘরের সঙ্গে কোনোভাবে আওয়ামী লীগ জড়িত আছে। কোনো সাইনবোর্ড, শেখ হাসিনা অথবা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো ছবি কোথাও নেই ঘরটির বাইরে বা ভিতরে।

আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বা নেত্রীর কোনো ছবি, সাইনবোর্ড কোনো কিছুই আমরা রাখিনি খুবই সচেতনভাবে। আমরা চাইনি যে এই ঘরটার পরিচিতি প্রকাশ করতে। এমনকি একটা দলীয় দপ্তরে যেসব ফাইল ইত্যাদি থাকে, সেসবও এখানে রাখা হয় না। নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ, বৈঠক ইত্যাদির জন্য একটা ঘর দরকার ছিল, এটা পাওয়া গেছে। এটাকে আমরা পার্টি অফিসই বলি, কিন্তু আদতে এটা একটা বাণিজ্যিক অফিস। আগে যে সংস্থা কাজ করত এখানে, তাদেরই ছেড়ে যাওয়া চেয়ার, টেবিল এসবই আমরা ব্যবহার করি। ’ আওয়ামী লীগের এই নেতা জানান, ৩০ থেকে ৩৫ জনের বৈঠক এই দপ্তরেই হয়ে যায়। কিন্তু একটু চাপাচাপি করে বসতে হয়। ছোটখাটো বৈঠক বিভিন্ন নেতার বাসাবাড়িতে এখনো হয়। তবে বড় বৈঠকগুলো, যেখানে শ দুয়েক নেতা-কর্মী হাজির হওয়ার কথা, সেরকম বৈঠকের জন্য কোনো ব্যাংকুয়েট হল বা কোনো রেস্তোরাঁর একটি অংশ ভাড়া নিয়ে নেওয়া হয়।

কারা যাতায়াত করেন পার্টি অফিসে : গত বছরের ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে চলে আসা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর অনেক শীর্ষ নেতা এবং সাবেক মন্ত্রী কলকাতা বা তার আশপাশের অঞ্চলে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন। এর বাইরে বিভিন্ন পেশাজীবী, সরকারি কর্মচারী, পুলিশ কর্মকর্তা ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারাও চলে এসেছেন ভারতে। মাস ছয়েক আগে আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো জানিয়েছিল যে অন্তত ৭০ জন সাবেক সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন জেলার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক, উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান, সাবেক মেয়রসহ শীর্ষ নেতাদের প্রায় ২০০ জন কলকাতা ও সংলগ্ন অঞ্চলে থাকছেন। তাদের কেউ সপরিবার থাকেন। আবার কোথাও একসঙ্গে কয়েকজন মিলেও একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন। কারও পরিবার মাঝেমধ্যে বাংলাদেশ থেকে এসেও কিছুদিন কাটিয়ে যায়।

আওয়ামী লীগের এক নেতা বলছিলেন, এখন যে সংখ্যাটা খুব বেশি বেড়েছে, তা নয়। দ্বাদশ সংসদের ৮০ জনের মতো সংসদ সদস্য এবং তারও আগে সংসদ সদস্য ছিলেন, এমন ১০ থেকে ১২ জন নেতা আছেন এখানে। আবার এমনও কয়েকজন এসেছেন, যারা কলকাতায় এসে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া বা অন্য দেশে চলে গেছেন। কলকাতা বা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আওয়ামী লীগের যে শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বাস করছেন, তাদের প্রায় সবাই পার্টি অফিসে যাতায়াত করে থাকেন।

আওয়ামী লীগের ওই নেতা বলছিলেন, তবে অফিস খোলার নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। যেরকম প্রয়োজন, সেরকমই আসেন নেতারা। আবার রোজই যে সবাই আসেন, তা-ও নয়। আসলে প্রয়োজনীয়তা ছিল একটা নির্দিষ্ট জায়গা গড়ে তোলা, সে জন্যই এই পার্টি অফিস।