প্রশাসনের নাকের ডগায়, সিলেটে চলছে পাথর চুরির মহোৎসব

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাদা সোনাখ্যাত দেশের শীর্ষ পর্যটন কেন্দ্র ভোলাগঞ্জ সাদা পাথরে অবাধে পাথর লুটপাট চলছে। যেন দেখার কেউ নেই। দিনেদুপুরে অবাধে লুটপাটের কারণে বিলীন হবার উপক্রম ওই পর্যটন স্পটটি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার দাবি করা হলেও বাস্তবে লুটপাট কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না।

স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল কাদির জানান, একসময় রাতের আঁধারে মাঝেমধ্যে পাথর চুরি হলেও এখন দিনদুপুরে চুরি হচ্ছে কয়েক কোটি টাকার সা‌দা পাথর। যার কারণে এখন বিলীন হওয়ার উপক্রম সাধা পাথর। প্রশাসনের সামনে দিয়ে বালু-পাথর লুট করে নিয়ে গেলেও কোনো কর্ণপাত নেই তাদের। সাদা পাথর লুটের জন্য ওই এলাকার বাসিন্দারা প্রশাসনকেই দুষছেন। তারা বলছেন, প্রশাসনের ব্যর্থতা আর মদদে এই লুটপাট চলছে।—প্রতিবেদন ঢাকা ট্রিবিউন এর।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর থেকেই সাদা পাথরে শুরু হয় এই লুটপাট। পরে স্থানীয় ও সেনাবাহিনীর কারণে তা অনেকটা বন্ধ হয়। কিন্তু, তবুও সুযোগ বুঝে চলে এই লুটপাট। বিভিন্ন সময়ে প্রশাসন ধলাই নদীতে অভিযান চালালেও বন্ধ হয়নি এই লুটপাট। এক সপ্তাহ লুটপাট হলে অভিযান হয় একদিন আর ওইদিন বাদে বাকি ছয়দিনই চলে এই লুটপাট। যেদিকে পাথর কেনাবেচা হয় এবং গাড়ি বা বড় নৌকা করে পাথর যায়, সেদিকে অভিযান না হওয়াতে এই লুটপাট বন্ধ হচ্ছে না বলে দাবি করছেন এলাকাবাসী। আর এ কারণে এখন বিলীনের পথে রয়েছে সাদা পাথর।

সরেজমিন সাদা পাথরে গিয়ে কথা হয় বেশ কয়েকজন শ্রমিকদের সঙ্গে। তারা জানান, সেখানে প্রতিদিন প্রায় ৪ থেকে ৫ হাজার শ্রমিক পাথর লুটে নিয়োজিত। যাদের মধ্যে পাঁচ ভাগের এক ভাগ স্থানীয় লোক, আর বাকিরা বহিরাগত। এরমধ্যে বেশিরভাগই সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জের লোকজন। যারা ধলাই নদী তীরবর্তী এলাকায় ভাড়ায় থেকে প্রতিদিন নৌকা নিয়ে এসে পাথর লুট করে।

কাউসার নামে সুনামগঞ্জ থেকে আসা এক শ্রমিক ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “আমরা দুইজন প্রতিদিন প্রায় ৩ থেকে ৪ ট্রিপ (৪টি বারকি নৌকা) দেই। প্রতি ট্রিপে ২,৫০০ টাকা থেকে ২,৬০০ টাকা পাওয়া যায়। আগে বাংকার থেকে যখন পাথর নিতাম, তখন নৌকাপ্রতি সাড়ে ৩,০০০ টাকা পেতাম। আর তখন প্রশাসনকে নৌকাপ্রতি ৩০০ টাকা দিতে হতো। এখন কাউকে দিতে হয় না।”

তিনি আরও বলেন, “তবে স্থানীয় কিছু নেশাখোর সকালে আসে টাকা নেওয়ার জন্য। জোর করে অনেকের কাছ থেকে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা নেয়। এখান থেকে এখন বেশি পাথর যাওয়ায় দাম কম পড়ছে। গত ৪-৫ মাস থেকেই এখানে পাথর উত্তোলন করি। তেমন কোনো সমস্যা হয় না। আগে বাংকারে কেউ ডিস্টার্ব করতো না। এখন মাঝেমধ্যে বিজিবি ও পুলিশ অভিযান চালায়। এখানে ৪-৫ হাজার মানুষ। কতজনকে তাড়াবে। আমরা তো সংসার চালানোর জন্য এ পেশায় আছি।”

নদীর দুই ধারে প্রতিদিন সাদা পাথর ও বাংকার থেকে নৌকা করে আসা পাথর বিক্রি হয়। এখানে নদীর ধারে পাথর কিনে পরে সেটা অন্যত্র বিক্রি করা হয়। স্থানীয় ও বহিরাগত ব্যবসায়ী যারা আছেন, তারা নৌকা থেকে পাথর কিনেন। পরে এই পাথর সারাদেশে বিক্রি করা হয়।

যখন নদীতে অনেক বেশি নৌকায় পাথর যায়, এলাকার মানুষজন এটি নিয়ে কথা বলেন, তখন প্রশাসন অভিযানে যায়। অভিযানে গিয়ে কয়েকটি কাঠের নৌকা ভেঙে পাথর লুটকারদের তাড়া দেয়। পরে ৪-৫ মিনিটের মধ্যে আবার আগের মতো লুটপাট চলে। দিনে বারকি নৌকা ও ইঞ্জিনচালিত নৌকা দিয়ে পাথর লুটপাট হলেও রাত হলেই শুরু হয় বড় বড় স্টিল বডির নৌকা দিয়ে পাথর লুট। এসব নৌকা যদি কখনও রাতের আঁধারে পাথর নিতে গিয়ে ধলাই সেতুতে ধাক্কা দেয়, তাহলে সেটি ধসে পড়ার আশংকা রয়েছে বলে স্থানীয়দের অভিমত।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সিলেটের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ সাহেদা আখতার ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “প্রশাসনকে আমি সাদা পাথর রক্ষার্থে ব্যর্থ বলবো না। ব্যর্থ তারা তখনই হতো, যখন চেষ্টা করতো। সাদা পাথর রক্ষার্থে তো তারা কখনও কোনো চেষ্টাই করেনি। প্রশাসনের উদাসীনতাই সাদা পাথরের জন্য কাল হয়েছে। অথচ এক বছর আগেও সাদা পাথরে কেউ হাত দেওয়ার সাহস পায়নি।”

সিলেটের সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্র উন্মুক্ত করা হলোসিলেটের সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্র উন্মুক্ত করা হলো
সিলেটের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “সাদা পাথর রক্ষার্থে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। কিন্তু কোনোভাবেই লুট বন্ধ হচ্ছে না।” আগে এটি রক্ষা করতে পারলেও এখন কেন পারছেন না প্রশ্ন করলে একই উত্তর দেন, “আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। সোমবার জেলা থেকে ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়েছি।”

কোম্পানীগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আজিজুন্নেছা ঢাকা ট্রিবিউনকে জানান, সোমবারও তারা সাদা পাথরে সাড়ে ৪ ঘণ্টা অভিযান চালিয়েছেন। গত মঙ্গলবার থেকে সোমবার পর্যন্ত মোট ৪ দফা অভিযান চালানো হয়েছে।

লুটপাট কেন বন্ধ হচ্ছে না এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “মোবাইল কোর্ট তো ২৪ ঘণ্টা চালানো যায় না। এ কারণে বন্ধ করা যাচ্ছে না পাথর চুরি। তবে এ ব্যাপারে সর্তক আমরা সতর্ক আছি।”