স্বাধীন হয়নি গণমাধ্যম! সাংবাদিকের মর্যাদাকে তাচ্ছিল্য করে সিএমপি কমিশনারের হুমকি

সম্প্রতি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল২৪ সংবাদ প্রচার করে। ওই সংবাদের প্রতিবাদ জানিয়ে সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ সাংবাদিকদের উদ্দেশে ‘হুমকিস্বরূপ বার্তা’ দেন।

প্রতিবাদের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ডবলমুরিং থানায় পেশাগত দায়িত্ব পালনরত এক সাংবাদিককে ২০ মিনিট হাজতে আটকা রাখা হয় এবং আরও এক সাংবাদিককে হেনস্তার শিকার হতে হয়। এ ঘটনায় সাংবাদিক মহলে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এবং পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

চ্যানেল২৪-এর প্রতিবেদনে দেখানো হয়, পুলিশ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা আটক করে জরিমানা আদায় করছে, পরে সেই রিকশা আবার ধরা হচ্ছে। জরিমানার নামে নেওয়া টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে কর্মকর্তাদের পকেটে যাচ্ছে।

সন্ধ্যায় সিএমপি কমিশনারের ‘হুমকি’

১৯ আগস্টের ওই সংবাদের প্রতিবাদ জানিয়ে গতকাল সন্ধ্যায় একটি প্রতিবাদলিপি দেন সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ। প্রতিবাদে চ্যানেল২৪-এ প্রচারিত সংবাদকে ‘সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যমূলক’ দাবি করা হয়। এছাড়া ‘পুলিশ বাহিনীর কোনো কার্যালয়ে প্রবেশ করে বিনা অনুমতিতে ভিডিও ধারণ করা বেআইনি এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের শামিল’ বলেও উল্লেখ করা হয়। ‘ভবিষ্যতে এমন আচরণের পুনরাবৃত্তি হলে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে’ বলে হুমকিও দেওয়া হয়।

রাতেই ডবলমুরিং থানায় সাংবাদিক আটক, হেনস্তা

এদিকে, গতকাল পোশাক শ্রমিকদের সড়ক অবরোধের খবর পেয়ে রাতে সংবাদ সংগ্রহে ঘটনাস্থলে যান দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকার মাল্টিমিডিয়া প্রতিবেদক সাহিদুল ইসলাম মাসুম। তখন পোশাকশ্রমিকরা বকেয়া বেতনের দাবিতে থানা প্রাঙ্গণে অবস্থান করছিলো। ওইসময় ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বাবুল আজাদ পেশাগত দায়িত্বপালনকে মাসুমকে অকথ্য ভাষায় গালি গালাজ শুরু করেন। পরে সাংবাদিকরা জড়ো হয়ে তার কার্যালয়ে গেলে সেখানে কথা বলার এক পর্যায়ে ওসি তেড়ে এসে তাকে টেনেহিঁচড়ে হাজতে নিয়ে আটকে রাখেন।

প্রায় ২০ মিনিট তাকে আটকে রাখার পর এক পর্যায়ে টেনে হিঁচড়ে আবার থানা হাজত থেকে বের করে দেওয়া হয়। এছাড়াও সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পরেও অসৌজন্যমূলক আচরণ করা হয় দৈনিক আজকের পত্রিকার মাল্টিমিডিয়া রিপোর্টার আবদুল কাইয়ুমের সঙ্গে।

সাংবাদিক সাহিদুল ইসলাম মাসুম বলেন, ‘পোশাক শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করলে আমি সেটি লাইভ করছিলাম। তখন ওসি আমাকে গালাগালি করেন। এরপর তিনি আমাকে থানায় আটকে রাখেন।’

হেনস্তার শিকার সাংবাদিক আবদুল কাইয়ুম বলেন, ‘ডবলমুরিং থানার ওসিকে আমার পরিচয় দেওয়ার পরেও তিনি চরম দুর্ব্যবহার করেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সহকর্মী মাসুমকে আটক করে হাজতে রাখেন। যদিও পরে সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে ২০ মিনিট পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।’

সাংবাদিক মহলে ক্ষোভ

পুলিশ কমিশনারের হুমকিস্বরূপ প্রতিবাদ এবং সাংবাদিক হেনস্তায় ক্ষোভ প্রকাশ ও প্রতিবাদ জানিয়েছে চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন (সিইউজে), চট্টগ্রাম টেলিভিশন রিপোর্টার্স নেটওয়ার্ক (সিটিআরএন) এবং চট্টগ্রাম মাল্টিমিডিয়া রিপোর্টার্স ইউনিটি (সিএমআরইউ)।

সিএমপির মতো একটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায় থেকে হুমকিমূলক বক্তব্য ফ্যাসিবাদী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ উল্লেখ করে সিইউজে নেতৃবৃন্দ বলেন, ‘নিজেদের অনিয়ম আড়াল করতে ভয়ভীতি দেখিয়ে সংবাদমাধ্যমকে দমন করা যাবে না। যদি কোনো প্রতিবেদনে সত্যতা থাকে, তবে প্রশাসনিকভাবে ব্যবস্থা নেয়াই সঠিক পথ। অবিলম্বে বক্তব্য প্রত্যাহার না করলে সাংবাদিক সমাজ কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবে।’

সিএমপি কমিশনারের বিবৃতি প্রতিবাদের আড়ালে ‘ক্ষমতা জাহিরের’ চেষ্টা বলে মন্তব্য করেছে চট্টগ্রাম টেলিভিশন রিপোর্টার্স নেটওয়ার্ক। তাঁর এমন কর্মকাণ্ড গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করে উল্লেখ করে এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে সংগঠনটি।

এ বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার হাসিব আজিজ, উপ-পুলিশ কমিশনার (পশ্চিম) হোসাইন মোহাম্মদ কবির ভূইয়া এবং ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বাবুল আজাদকে একাধিকবার কল করা হলেও তাড়া সাড়া দেননি।

তবে নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) মাহমুদা বেগম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ডবলমুরিংয়ের ঘটনায় ডিসি উপস্থিত থেকে বিষয়টি সমাধান করেছেন। ডিসি ও ওসি বিস্তারিত বলতে পারবেন।’ তবে কমিশনারের দেয়া হুমকি নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।