খুলনা প্রতিনিধি ::
যশোর জেলাধীন অভয়নগর উপজেলার কারিশাকুল গ্রামের ৮২ বছরের বৃদ্ধ নগেন্দ্রনাথ রায়। তিনি ভবদহে স্লুইস গেইট তৈরি হতে দেখেছেন। স্লইস গেট তৈরি পরবর্তী সময়ে কৃষিতে যে উন্নতি হয়েছিল, তাতে তিনিসহ সকলে বেশ উৎফুল্ল ছিলেন। কিন্তু কিছুকাল পর থেকেই জলাবদ্ধতার দুর্যোগ তাঁদের মুষড়ে দিয়েছে। নগেন্দ্রনাথ বলেন, ’ভবদহের সুইসগেট তৈরি হয়েছিল নোনা পানি আটকানোর জন্য, তা যে অভিশাপ হিসেবে দেখা দেবে তা বুঝতে পারিনি। শেষ বয়সে এসে
হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি এই সুইসগেট ও বাঁধ আমাদের ভয়ানক ক্ষতি করেছে।’ সম্প্রতি কয়েকদিনের অতিবৃষ্টিতে ভবদহ এলাকায় পানি থৈ থৈ করছে। এই বয়সেও তিনি মাছের আশায় জাল নিয়ে বেরিয়েছেন। দু’দিন আগে ভবদহ এলাকায় তাঁর সাথে কথা হয়। সুইসগেট তৈরির সময় তিনি এখানে কাজ করেছেন। বাঁধ ও সুইসগেট ব্যবস্থায় এলাকার উন্নতি হবে বলে মনে করেছিলেন। কিন্তু তা আজ
এই এলাকার দশ লক্ষাধিক মানুষের দু:খে পরিণত হয়েছে। মৌসূমী বৃষ্টি বেশী হলেই ভবদহ অঞ্চলে জলাবদ্ধতার মাত্রা বাড়ে। জোয়ারের পানিতে আসা পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে পানি নিষ্কাশনের হরি ও টেকা নদী। এবারের বৃষ্টিতেও বালিধা, পাঁচাকড়ি, বাজে-কুলটিয়া, মশিয়াহাটি, হাটগাছা, সুজাতপুর, ডুমুরতলা, লখাইডাঙ্গা, মশিয়াহাটি, নেহালপুর ও কপালিয়াসহ ২৫টি গ্রাম জলাবদ্ধতার কবলে পড়েছে। গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতে এখন হাঁটু পানি। অভয়নগর গ্রামের বাসিন্দা রাজকুমার বিশ্বাস (৬৪) জানান, বালিধা বিলে তার ৫টি মাছের ঘের ছিল। সেই ঘের গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে তলিয়ে মাছ ভেসে গেছে। নেট দিয়ে আটকানোর অবস্থাও নেই। পাঁচাকড়ি গ্রামের স্বরস্বতি দাশ (৫৫) তলিয়ে যাওয়া বসতঘরের বারান্দায় মাঁচা করে মাটির চুলায় রান্না করছিলেন। তিনি বলেন, ছেলের বৌকে তিনমাস বয়সী নাতিসহ তারা বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। বিশুদ্ধ পানি ও পয়:নিষ্কাশনের সুবিধা সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। বালিধা গ্রামের শেফালী রানী দাশের (৫৬) বসত ঘরের সিঁড়ির উপর বসে তার পোষা গরুটির মাথায় হাত বুলাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, নিজেদেরই খাবার নেই, গরুটিকে আর কী খাওয়াবো! পাঁচাকড়ি গ্রামের রণজিত দাশ (৬৬) জলাবদ্ধতা স্থায়ী হওয়ার জন্য জনপ্রতিনিধিদের দুষলেন। তিনি বলেন, ভবদহ বিলের সমস্যা সমাধানে সরকার কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। সেগুলো স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা লুটেপুটে খেয়েছে। তার মতে, বিলগুলোর সাথে নদীর সংযোগ ঘটিয়ে দিলে বদ্ধ পানি বের হতে পারতো। এতে নদীও প্রাণ ফিরে পেতো; কিন্তু এই
সহজ কাজটি ইঞ্জিনিয়ার বা জনপ্রতিনিধিরা কেউই করছে না। ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক রণজিত বাওয়ালী বলেন, টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) বন্ধ করে দিয়েছে। এটি কার্যকর না হওয়ায় আমরা স্থায়ী জলাবদ্ধতার শিকার হতে চলেছি।’ যশোর ও খুলনার ৩৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে এক নামে ভবদহ এলাকা বলা হয়। এখানে ১০ লক্ষাধিক মানুষের বাস। এই এলাকার পাঁচটি নদীতে বাঁধ দিয়ে ভবদহ নামক স্থানে ২১ কপাটের স্লুইস গেট তৈরি করে কৃত্রিম এক পানি নিষ্কাষণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। উদ্দেশ্য ছিল জলেচ্ছ্বাস ও নোনা পানির হাত থেকে ভবদহ
এলাকার অর্ধশত বিলকে রক্ষা করে ফসল ফলানোর উপযোগী করে তোলা। মাত্র ২০ বছর যেতে না যেতেই নদীর জোয়ারে আসা পলি বিলে যেতে না পেরে নদীর বুকে জমা হয়ে নদী শুকাতে থাকে। বিপরীতে বিলের পানি নিষ্কাশিত হতে না পেরে জলাবদ্ধতা দেখা দিতে শুরু করে। জলাবদ্ধতা নিরসনে একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও তা কাজে আসেনি। এ বিষয়ে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান বলেন, ভবদহের জলাবদ্ধতা দীর্ঘদিনের সমস্যা। এটি দূরীকরণে সরকার ইতোপূর্বে টিআরএম পদ্ধতি বাস্তবায়ন করেছে। পাম্প মেশিনের মাধ্যমেও পানি নিষ্কাশনের চেষ্টা করা হয়েছে। সাম্প্রতিক অতিবৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতা বেড়েছে। যা নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ
নেয়া হচ্ছে।